Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

সলপ ইউনিয়নের ভাষা ও সাংস্কৃতি

 

ভাষা ও সংস্কৃতি

 

সলপ ইউনিয়নের সবাই বাঙ্গালী, তাই তাদের একই ভাষা-বাংলা।ভাষা ও সাংস্কুতিতে আমাদের সলপ ইউনিয়ন একটি প্রশিদ্ধ ইউনিয়ন । এখানে ১৯৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধে এখানে ভাষার  জন্য প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সেই বাংলা ভাষার উচ্চারণের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। গ্রামবাসী ও শহরবাসীর উচ্চারণের মধ্যে সাধারণতঃ পার্থক্য পাওয়া যায়। তার কারণ শহরের মানুষ অধিকাংশই শিক্ষিত, তাই তারা শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে এবং বলতে পারে, যা’ অধিকাংশ অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। প্রসঙ্গক্রমে গ্রামীণ ভাষার কিছু নমুনা নিম্নে উদ্ধৃত করা হ’ল।

গ্রাম্য উচ্চারণ

শুদ্ধ কথা

গ্রাম্য উচ্চারণ

শুদ্ধ কথা

আঁঠ্যা

উচ্ছিষ্ট

ছ্যাপ

থুথু

উর‌্যাৎ

উরুদেশ

ডাঙ্গর

বড়

কচলান

মাজা

কেডা

কে

কনে

কোথায়

প্যাঁক

কাদা

কুত্যা

কুকুর

গতর

শরীর

শিশুর নামকরণ

হিন্দু এবং মুসলমান সকলেই পুত্র কন্যার দুইটি করে নাম রাখে; একটি চলিত বা ডাক নাম, অপরটি; ভাল নাম। হিন্দুদের মধ্যে রাধাবল্লভ, পার্বতীশঙ্কর, কালিদাস প্রভৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে মহম্মদ, ইয়াকুব, রহিম, করিম প্রভৃতি নাম প্রচলিত ছিল। বর্তমানে শিশুদের নামকরণে আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অভিভাবকগণ শিশুর নামকরণে পাশ্চাত্য ধারাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

 

শোকপ্রকাশ

সাধারণ লোক উচ্চস্বরে ক্রন্দন করে শোক প্রকাশ করে। ভদ্রবংশীয় হিন্দু মুসলমান স্ত্রী-পুরুষ সকলেই আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতে ধীরে ও নীরবে শোক প্রকাশ করে। সাধারণ শ্রেণীর লোক উচ্চ রবে মৃত ব্যাক্তির গুণাবলি কীর্তন করত যে ক্রন্দন করে তা দূর হতে গীতধ্বনি বলে প্রতীয়মান হয়।

 

আচার অনুষ্ঠান

 

পূর্বে হিন্দু সমাজে কন্যাপণ দিতে হত। এখনও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে এই প্রথা বর্তমান আছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে পাত্রপণ ক্রমশই অধিক প্রচলিত হচ্ছে। ভদ্রসমাজে বরযাত্রীগণের আবদার ও উৎপাতে এবং চা, বিস্কুট, সোডা, লেমোনেড সরবরাহ করতে কন্যা কর্তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে এধরণের অত্যাচার বিশেষ পরিলক্ষিত হয় না। মুসলমান সমাজেও আতশবাজি ব্যবহার ও প্রীতি উপহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

কুসংস্কার

সলপ ইউনিয়নের লোকের মধ্যে নানারূপ সংস্কার পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ ভূতে পাওয়া বা ধরা, ব্রহ্মদৈত্য আনা ইত্যাদি। কারো কারো মধ্যে বার আসা, অন্যের উন্নতি বা ব্যাধি পীড়ায় ঈর্ষামূলে চোখ দেওয়া, রাত্রিতে দোকানদারগণের কোনও কোনও দ্রব্য যথা হলুদ, মধু, হরিতকি বিক্রয় না করার সংস্কার পরিলক্ষিত হয়।

 

পার্বন

মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আজহা, মোহররম, শব-ই-বরাত, ফাতেহা-ই-ইয়াজ-দাহম, আখেরী চাহার শোম্বা প্রভৃতি। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা, কালী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, জন্মষ্টমী প্রভৃতি। খৃষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মদিন, গুডফ্রাইডে ইত্যাদি। দোলযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা, পু্ষ্পদোল, লক্ষ্মীপুজা, কার্তিকপুজা, বাসন্তীপুজা প্রভৃতি উপলক্ষে এই জেলার স্থানে স্থানে বিশেষ আমোদ উৎসব হয়ে থাকে। নষ্টচন্দ্রা ও হরিতালিকা দিনে বালকেরা যে কৌতুক ও আমোদ উপভোগ করে তা অনেক সময় লোকের অনিষ্টকারক হয়ে থাকে।

 

ব্রত পূজা

সলপ ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, নবশাক এবং সাহা সম্প্রদায়ের মধ্যে অমাবস্যা ব্রত, যমপুকুর, পুণ্যপুকুর, অশোকষষ্ঠী, জামাইষষ্ঠী, চাপড়ষষ্ঠী, সাবিত্রী, রামনবমী, সম্পদনারায়ণ, জন্মাষ্টমী, মঙ্গলচন্ডী, শুভচন্ডী, কুলাইচন্ডী, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি ব্রত পুজাদি সর্বত্র বিদ্যমান আছে। কার্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ দেয়া এবং পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিনে গাভী ছেড়ে দেয়ার ও তাড়ানোর প্রথা বর্তমান আছে।

 

আবাস

সাধারণত পল্লীবাসী উলুখড় নির্মিত ‘বাঙ্গালা’ ‘চৌরী’ কাঁচাগৃহে বাস করে। কেনেস্তারা ও করগেট টিনের গৃহ ৩৫/৪০ বৎসর ধরে প্রচলিত আছে। ধণী লোক দালানে বাস করে। অতি পূর্বে এ দেশের মাটির কোঠা প্রচলিত ছিল। অধুনা ডেমরা কোঠার নিদর্শন আছে। কপাট জানালার ব্যবহার সর্বত্রই আছে্। গরিব লোক কপটের পরিবর্তে চাটাই নির্মিত বেড়া বা ঝাঁপ ব্যবহার করে। তবে যে সব গ্রামে বাজার বা হাট আছে, ব্যবসায়ী আছে, সেসব গ্রামে কিছু কিছু পাকা দালান আছে। কাঁচা বাসার সংখ্যা নগণ্য-প্রায় সবাই পাকা দালানে বসবাস করে। কিছু ছোট ছোট রাস্তা আছে যা পাকা তবে কংক্রীট বা পিচঢালা নয়।

 

খাদ্য

সলপ ইউনিয়নের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, রুটি, ডাল, শাক-সবজি, মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি। গ্রামে পান্তা ও কড়কড়া ভাতের বহুল প্রচালন আছে। এমনকি অবস্থাসম্পন্ন ঘরেও সকালে বাসী তরকারীর সঙ্গে পান্তা খাওয়া হয়। খাদ্যের প্রশ্নে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নাই, একমাত্র গরুর গোশত ব্যতীত, যা হিন্দুরা খায় না। তবে যে হিন্দুরা এককালে পেয়াজ, রসুন, মুরগী, ডিম, গরু প্রভৃতির নাম শুনলে নাক সিটকে দুরে সরে যেত, বর্তমান কালে তারা সে সব খাদ্যের বড় সমঝদার হয়ে পড়েছে। গ্রামের সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারে নানা ধরণের পিঠা যেমন- সরা পিঠা, পাটী সাপ্টা, ছিটা পিঠা, রুটি পিঠা, পরটা, তেল পিঠা, কুস্লী পিঠা, তাল পিঠা, তাল বড়া, সেমাই, পায়েস, হালুয়া, দুধের ক্ষীর, ভাপা পিঠা (ধুকী পিঠা) প্রভৃতি প্রস্ত্তত হয়ে থাকে। বিশেষ করে জামাই আসলে বা কোন মেহমান আসলে সে সব খাবার অবশ্যই বাড়ীতে হ‘তে হবে এবং তা’হয় প্রধানতঃ পরিবারের ইজ্জত বা Prestige এর প্রশ্নে। এমন কি বহু পরিবারে সঙ্গতি না থাকলেও দেনা করে, ঐ সব খাবার তৈরি ক‘রে মেহমান নওয়াজী দেখাতেহয়। তাই তাকে কৃষ্টির অঙ্গ বলে ধরা হয়।

 

পরিচ্ছদ

সলপ ইউনিয়নের নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোন পোষাক কোনদিনই ছিলনা, আজও নেই। তবে হিন্দু মুসলমানের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নে কিছুটা পার্থক্য আছে। হিন্দুরা ভাবে ধুতিই তার জাতীয় পোষাক আর তার সাথে ফতুয়া ও চাদর। পায়জামা, পাঞ্জাবী, সেরওয়ানী, লুঙ্গী, টুপি, জুতা প্রভৃতি সাধারণতঃ মুসলমানের নির্দিষ্ট পোষাক বলে প্রচলিত আছে। ইদানিং হাফহাতা হাওয়াই সার্ট, ফতুয়া, খাটো পাঞ্জাবী ইত্যাদির রেওয়াজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পায়ে জুতা অথবা স্যান্ডেল থাকে। হিন্দুরা ধুতি ও সার্ট বা পাঞ্জাবী পরে। শিরস্রাণের ব্যবহার সচরাচর নাই। উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েরা শাড়ী, ব্লাউজ, সেমিজ, জামা, পায়জামা, ওড়না, স্কার্ট, ম্যাক্সি ইত্যাদি পড়ে। ইদানিং কিশোরী মেয়েদের মধ্যে বোরকার পাশাপাশি ফতুয়া-জিন্স এর ব্যবহারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

খেলাধুলা

 

লাঠিখেলা সলপ ইউনিয়নের একটি প্রসিদ্ধ খেলা। হাটখালির লাঠিয়ালগণের বিশেষ সুনাম আছে। গারসি ও মহরম সময়ে সর্বত্রই লাঠিখেলার প্রচলন আছে। ৩০ আশ্বিন সলপ ইউনিয়নের ‘গারসি’ বলে পরিচিত। এই দিনে সাধারণ হিন্দু মুসলমানগণের অনেকেই কুস্তি ও মল্ল ক্রীড়াদি প্রদর্শন করে থাকে। পলো নিয়ে মাছমারা এই সলপ ইউনিয়নের  লোকের একটি প্রাচীন আমোদ। মহিষের সিঙা বাজিয়ে লাঠি ও পলো কাঁধে নিয়ে শতাধিক লোক একত্রিত হয়ে বিল জলাশয়ে মাছ ধরে। এরা ‘‘বাহুত’’ নামে পরিচিত।

 

নৌকাচালনে সলপ ইউনিয়নের লোক বিশেষ অভ্যস্ত। দুর্গোৎসবে পোতাজিয়া গ্রামের নৌকাবাইচ প্রথা ও পানসি নৌকার সাজ এবং সারি গানের আমোদ বহুদিন হতে প্রচলিত। এ দেশের বালকদের মধ্যে শীতকালে ঘুড়ি বা ঘুন্নি উড়ানোর প্রথা প্রচলিত আছে। এটি একটি প্রধান ক্রীড়া বা আমোদ বলে গণ্য। হাডুডু বা হৈলডুবি অনেক অঞ্চলে প্রচলিত। ডান্ডাগুলি, কঢ়িখেলা, লাটিমকাচ্চা প্রভৃতি বালকদের মধ্যে, তাস আবালবৃদ্ধবণিতা এবং পাশা, দাবা যুবক ও বৃদ্ধগণের মধ্যে দেখা যায়। কোথাও কোথাও তুরমি খেলা প্রচলিত আছে। চান্দাইকোণায় পৌষ পার্বণে চিঠি খেলার বিশেষ প্রচলন আছে। বর্তমানে স্কুল কলেজে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস ইত্যাদি খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

 

আঞ্চলিক গান

 

সলপ ইউনিয়নের গানে সমৃদ্ধ। এখানের মাঠে ঘাটে গ্রামান্তরে অজস্ত্র লোকসংগীত শ্রুত হয়। এগুলোর মধ্যে বরস্যা গান উল্লেখযোগ্য। যে গানে ভালবাসায় সিক্ত গ্রামের একজন বধুর অনুভুতি বর্ণনা করা হয়েছে।

ওগো শুন শুন বলছি পতি

 

যাইও না বিদ্যাশে

 

পতি ছাইর‌্যা সতী নারী

 

ওরে কেমনে থাইক গো বোইস্যা।

 

আবার কোন কোন বরস্যা গান আছে যেগুলোতে কোন একটি নির্দিষ্ট মাসে প্রকৃতির অবস্থা বর্ণনা করা হয়। নিম্নের গানে বাংলা আষাঢ় মাসের কথা বলা হয়েছে।

আষাঢ় মাসে আঁদলেতে

 

বোঝাই নদী নালা

 

পোখ পাহালী বিজ্যা মরে

 

হারে কিন্যা দুক্কের জ্বালা।

 

একজন বয়াতীর নেতৃত্বে আরো কিছু গায়ক কোরাস করে ধুয়া গান পরিবেশন করে। যেমন

মন্রে লা-ইলাহা পড়

 

মন্রে নেক্ পথে চল

 

বদ্পথে হ’য়ো না খাড়া

 

আযাব হবে বাড়া।

 

সলপ ইউনিয়নের আরো যে সমস্ত গান প্রচলিত আছে সেগুলোর মধ্যে ঘুপপাড়ানী গান, বিয়ের গান, ঘুম ভাঙ্গানো গান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।